আমি একজন পারফেকশনিস্ট মায়ের সন্তান ।
আমার মা একজন 'পারফেকশনিস্ট', বাংলায় যাকে বলা যায় 'পরিপূর্ণতাবাদী' !
আরও সহজ করে বললে আমাদের বাসায় 'ধূলোও যেনো ঢুকতে ভয় পায়' এমন দশাই বিরাজ করে।
আমার বন্ধু থেকে আত্মীয়পরিজন সকলের কাছেই আমার শৈশব-বেড়ে ওঠা-আমার সদ্য অতীত হওয়া জীবন (বর্তমানে মায়ের সাথে নেই তাই) অত্যন্ত ঈর্ষণীয় !
সেই বুঝ হওয়ার পর থেকে আমার মনে পরে না আমি আমাদের বাসা কখনও অগোছালো দেখেছি কি না। এমনকি ঝড়-ঝাপটা-বিপদ-আপদ, যত যাই কিছুই হোউক না কেনো আমাদের বাসা এক মুহূর্তের জন্যেও নোংরা হয়নি, এতটুকুন অগোছালো হয় নি, কোথাও কিঞ্চিৎ ধুলো জমে নি, কোথাও মরিচা পরে নি, সিংক এ হাড়ি-পাতিল-প্লেট-বাটি জমেনি, আমাদের কারো কাপড় (বাসায় আগত অতিথিসহ) আকাচাতো থাকেইনি বরঞ্চ ইস্ত্রী করা কাপড় যে যার ড্রয়ারে পেয়েছে সবসময়।
এমনকি আমার বাবা যখন অসুস্থাবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন, তখনও আমাদের বাসা এতটুকুন এলোমেলো হয় নি। মা সারারাত সারাদিন বাবার সেবা করার পরও কিছুক্ষণের জন্যে বাসায় এসে বাসা গুছিয়ে দিয়ে যেতেন।
আমার মা এ সকল কাজ একাই করেন ! সাহায্যকারী থাকলেও মা তাদের উপর বিশেষ আস্থা রাখতে পারেন না বিধায় সাহায্যকারীগণ বেশিরভাগ সময়ই নীরব দর্শকের ভূমিকাই বেশি পালন করেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি ব্রেকফাস্ট আর চা পেয়েছি, এমনকি আমার ক্যাম্পাসবেলায় সেই শীতের ভোর ৬ টা নাগাদ যখন বাসা থেকে বের হতে হয়েছে, তখনও ঠিক সাড়ে ৫ টায় ডাইনিং এ নাস্তা সাজানো পেয়েছি ! এর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনও।
এমনই ঠিক দেড়টায় লাঞ্চ, বিকেল সাড়ে ৪ টায় নাস্তা আর রাত ঠিক সাড়ে আটটায় ডাইনিং এ তৈরি ডিনার পেয়েছি।
শুধু তাই নয়, আমার পড়ার টেবিলে রাখা পানির ফ্লাস্কটি কখনই আমি ঘোলাটে এবং খালি দেখিনি! ফ্লাস্কটিতে গরমের দিনে শীতল আর শীতের দিনে গরমপানি পূর্ণ পেয়েছি।
একইরকমভাবে শীতের সময়টাতে ছুটির দিনে ঠিক সাড়ে দশটা নাগাদ স্নানকক্ষে গিয়েই গরম পানি পেয়েছি, আর বাসার বাহিরে থাকলে বাসায় আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই স্নানের জন্যে স্নানকক্ষে দেখেছি গরম পানি রাখা আছে ।
হুট করে কেউ আমাদের বাসায় গেলে তার মনে হতে পারে এ বাসায় কোনো রূপকথার গল্পের পরী আছেন, যিনি চোখের পলকে নিরলসভাবে সবার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছেন !
হ্যাঁ আমি একজন পারফেকশনিস্ট মায়ের সন্তান, এবং ঠিক এই কারণে কিছুদিন আগেও অন্য আর সবার মতন আমি নিজে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবতী ভাবতাম ।
আদতে কি তাই ?
সত্যিই কি পারফেকশনিস্ট মায়েদের সন্তানরা অত্যন্ত 'সৌভাগ্যশালী' ?
আমি সেই বুঝ হবার পর থেকে কেবল 'পেয়েই' এসেছি, 'করেছি' কম ! তাই আমার কাছে 'পাওয়াটা'ই যেনো স্বাভাবিক, 'নিজে কিছু করে নেওয়াটা' খানিকটা অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকরও !
এমন একজন মানুষ যখন বাস্তবজীবনে পদার্পণ করেন, তখন তার উপাগত জীবন ও আগামীর দিনগুলো তার নিকট হয়ে ওঠে এক ভীষণদর্শন !
একজন পারফেকশনিস্ট পিতা কিংবা মাতা ভুলে যান; তাঁর সন্তান কেবল তারই সন্তান, পুরো পৃথিবীর সন্তান নয় ! তাই তিনি সেই সন্তানকে যতই তার ডানার ভেতর আগলে রেখে তৈয়ারি জীবনে অভ্যস্ত করুন না কেনো, প্রকৃতির বিধানানুসারে বাস্তবতা একদিন তাকে টেনেহিঁচড়ে পিতা-মাতার বুক থেকে ছিনিয়ে নেবেই। আর সেদিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না থাকা আর তৈয়ারি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সেই সন্তান যাপিত জীবনের পথে অনেকটাই পিছিয়ে পরবে, আর একইসাথে জীবনের পথে সে হয়ে উঠবে নিরাধার !
পাখি যদি তার সন্তানটিকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে ফেলে না দিতো, তবে কিন্তু সেই ছানাটি কখনই উড়তে শিখবে না! জীবনভর খঁজই থেকে যাবে ।
তেমনই আমাদের বাবা-মায়েরাও সন্তানদের নিপট জীবনের লড়াইয়ের প্রস্তরে একাকী ছেড়ে দিন, যেনো সে একাই লড়তে শিখে যায়, তার জন্যে করা বাবা-মায়ের অমূল্য ত্যাগকে মূল্যায়ন করতে শেখে। একইসাথে এমনতর অন্ধভাবে ভালো না বাসুন, যেই ভালোবাসা সন্তানকে জীবনের পথে পঙ্গু বানিয়ে দেয় ।
এটি ঠিক অনুযোগ নয়, এটি অবগতি ।।