Loading...
Blogs

কেনো বাবা-মা হিসেবে পারফেকশনিস্ট না হওয়াই ভালো ?


18 January 2023   ||  1 year ago
Parenting

Moyomee Khondoker
Educationist

আমি একজন পারফেকশনিস্ট মায়ের সন্তান । 
আমার মা একজন 'পারফেকশনিস্ট', বাংলায় যাকে বলা যায় 'পরিপূর্ণতাবাদী' !  
আরও সহজ করে বললে আমাদের বাসায় 'ধূলোও যেনো ঢুকতে ভয় পায়' এমন দশাই বিরাজ করে। 
আমার বন্ধু থেকে আত্মীয়পরিজন সকলের কাছেই আমার শৈশব-বেড়ে ওঠা-আমার সদ্য অতীত হওয়া জীবন (বর্তমানে মায়ের সাথে নেই তাই) অত্যন্ত ঈর্ষণীয় ! 
সেই বুঝ হওয়ার পর থেকে আমার মনে পরে না আমি আমাদের বাসা কখনও অগোছালো দেখেছি কি না। এমনকি ঝড়-ঝাপটা-বিপদ-আপদ, যত যাই কিছুই হোউক না কেনো আমাদের বাসা এক মুহূর্তের জন্যেও নোংরা হয়নি, এতটুকুন অগোছালো হয় নি, কোথাও কিঞ্চিৎ ধুলো জমে নি, কোথাও মরিচা পরে নি, সিংক এ হাড়ি-পাতিল-প্লেট-বাটি জমেনি, আমাদের কারো কাপড় (বাসায় আগত অতিথিসহ) আকাচাতো থাকেইনি বরঞ্চ ইস্ত্রী করা কাপড় যে যার ড্রয়ারে পেয়েছে সবসময়। 
এমনকি আমার বাবা যখন অসুস্থাবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন, তখনও আমাদের বাসা এতটুকুন এলোমেলো হয় নি। মা সারারাত সারাদিন বাবার সেবা করার পরও কিছুক্ষণের জন্যে বাসায় এসে বাসা গুছিয়ে দিয়ে যেতেন। 
আমার মা এ সকল কাজ একাই করেন ! সাহায্যকারী থাকলেও মা তাদের উপর বিশেষ আস্থা রাখতে পারেন না বিধায় সাহায্যকারীগণ বেশিরভাগ সময়ই নীরব দর্শকের ভূমিকাই বেশি পালন করেন। 
সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি ব্রেকফাস্ট আর চা পেয়েছি, এমনকি আমার ক্যাম্পাসবেলায় সেই শীতের ভোর ৬ টা নাগাদ যখন বাসা থেকে বের হতে হয়েছে, তখনও ঠিক সাড়ে ৫ টায় ডাইনিং এ নাস্তা সাজানো পেয়েছি ! এর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনও। 
এমনই ঠিক দেড়টায় লাঞ্চ, বিকেল সাড়ে ৪ টায় নাস্তা আর রাত ঠিক সাড়ে আটটায় ডাইনিং এ তৈরি ডিনার পেয়েছি। 
শুধু তাই নয়, আমার পড়ার টেবিলে রাখা পানির ফ্লাস্কটি কখনই আমি ঘোলাটে এবং খালি দেখিনি! ফ্লাস্কটিতে গরমের দিনে শীতল আর শীতের দিনে গরমপানি পূর্ণ পেয়েছি। 
একইরকমভাবে শীতের সময়টাতে ছুটির দিনে ঠিক সাড়ে দশটা নাগাদ স্নানকক্ষে গিয়েই গরম পানি পেয়েছি, আর বাসার বাহিরে থাকলে বাসায় আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই স্নানের জন্যে স্নানকক্ষে  দেখেছি গরম পানি রাখা আছে । 
হুট করে কেউ আমাদের বাসায় গেলে তার মনে হতে পারে এ বাসায় কোনো রূপকথার গল্পের পরী আছেন, যিনি চোখের পলকে নিরলসভাবে সবার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছেন !  
হ্যাঁ আমি একজন পারফেকশনিস্ট মায়ের সন্তান, এবং ঠিক এই কারণে কিছুদিন আগেও অন্য আর সবার মতন আমি নিজে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবতী ভাবতাম । 
আদতে কি তাই ? 
সত্যিই কি পারফেকশনিস্ট মায়েদের সন্তানরা অত্যন্ত 'সৌভাগ্যশালী' ? 
আমি সেই বুঝ হবার পর থেকে কেবল 'পেয়েই' এসেছি, 'করেছি' কম !  তাই আমার কাছে 'পাওয়াটা'ই যেনো স্বাভাবিক, 'নিজে কিছু করে নেওয়াটা' খানিকটা অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকরও ! 
এমন একজন মানুষ যখন বাস্তবজীবনে পদার্পণ করেন, তখন তার উপাগত জীবন ও আগামীর দিনগুলো তার নিকট হয়ে ওঠে এক ভীষণদর্শন !  
একজন পারফেকশনিস্ট পিতা কিংবা মাতা ভুলে যান; তাঁর সন্তান কেবল তারই সন্তান, পুরো পৃথিবীর সন্তান নয় !  তাই তিনি সেই সন্তানকে যতই তার ডানার ভেতর আগলে রেখে তৈয়ারি জীবনে অভ্যস্ত করুন না কেনো, প্রকৃতির বিধানানুসারে বাস্তবতা একদিন তাকে টেনেহিঁচড়ে পিতা-মাতার বুক থেকে ছিনিয়ে নেবেই। আর সেদিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না থাকা আর তৈয়ারি জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সেই সন্তান যাপিত জীবনের পথে অনেকটাই পিছিয়ে পরবে, আর একইসাথে জীবনের পথে সে হয়ে উঠবে নিরাধার ! 
পাখি যদি তার সন্তানটিকে ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে ফেলে না দিতো, তবে কিন্তু সেই ছানাটি কখনই উড়তে শিখবে না! জীবনভর খঁজই থেকে যাবে । 
তেমনই আমাদের বাবা-মায়েরাও সন্তানদের নিপট জীবনের লড়াইয়ের প্রস্তরে একাকী ছেড়ে দিন, যেনো সে একাই লড়তে শিখে যায়, তার জন্যে করা বাবা-মায়ের অমূল্য ত্যাগকে মূল্যায়ন করতে শেখে। একইসাথে এমনতর অন্ধভাবে ভালো না বাসুন, যেই ভালোবাসা সন্তানকে জীবনের পথে পঙ্গু বানিয়ে দেয় । 
এটি ঠিক অনুযোগ নয়, এটি অবগতি   ।।

Read more of this blogger
  • Awarness

    সামাজিক সচেতনতা

    আমরা জাতি হিসেবে এখনো কতোটা 'বনচর' (অসভ্য বলতে ভীষণ বাঁধছে) রয়ে গেছি তা আমাদের 'পাবলিক প্লেস' গুলোর শৌচাগার দেখলেই বোঝা যায়।
    যেমন রেলস্টেশন, বাস স্ট্যান্ড, সরকারি মেডিকেল, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কোনো সরকারি অফিস পাড়ার শৌচাগারও ! 

    বেশিরভাগ সুস্থ সাধারণ মানুষের মাঝেই এই প্রবণতাটা ভীষণ দেখা যায়; 'প্রাণ দেবো কিন্তু রেলস্টেশনের শৌচাগারে যাবো না', একইসাথে বাসস্ট্যান্ড ও সরকারি হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রেও একই মনোভাব প্রযোজ্য ! 

    অথচ যে বা যারা সেই শৌচাগারগুলো ব্যবহার করছেন, তারা সকলেই শিশু নন ? বরঞ্চ বেশিরভাগই প্রাপ্ত বয়স্ক ! 

    খাবার গ্রহণের যেমন কিছু আদব আছে, তেমনই শৌচাগার ব্যবহারেরও কিছু আদব-লেহাজ রয়েছে ; তা সে হোক ধর্মীয় দিক থেকে কিংবা সামাজিক দিক থেকে।

    সেই ছেলেবেলা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিশেষত হলে) মা থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ এবং হলের আপুদের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে এসছি,

    "শৌচাগার ব্যবহারের পরে পর্যাপ্ত পানি ব্যবহারের মাধ্যমে তা পরিচ্ছন্ন করুন, শৌচাগার থেকে বের হওয়ার পূর্বে অবশ্যই পেছন ফিরে চোখ বুলিয়ে নিন। আপনার ব্যক্তিগত কোনো কিছু যেনো অন্যকে বিব্রত না করে। এটি যারপরনাই অসভ্যতা এবং আপনার এহেন আচরণ আপনার নিজ বংশকে নীচ প্রমাণ করে" ।। 

    বর্তমান সময়ে অবস্থা আরো ভয়াবহ, পাশ্চাত্যের অনুকরণে দেশ এখন 'হাই কমোড' বা 'ইংলিশ কমোড' রোগে আক্রান্ত ! 
    যেটা ব্যক্তির ব্যক্তিগত থাকাই ভালো, আর যদি জনসাধারণের নিমিত্তেই ব্যবহার করতে হয়, তবে এটি ব্যবহারের আদবটি অন্তত শিখিয়ে দেয়া হোক।

    আমরা বাঙ্গালিরা বরাবরই 'আংশিক অনুকরণে' সিদ্ধহস্ত। তেমনই আমরা পাশ্চাত্য থেকে 'বসে বসে আসন পেতে' মল ত্যাগের ব্যাপারেটি শিখলাম কিন্তু তা পরিচ্ছন্ন রাখার আদবটি শিখলাম না।
    এজন্যই পাবলিক প্লেসে 'গণশৌচাগারের' কথা না হয় বাদই দিলাম, কর্পোরেট অফিস পাড়াগুলোতেও এখন শৌচাগার ব্যবহার দায় হয়ে পড়েছে !  অথচ সেই অফিসপাড়াগুলোতে যারা কাজ করেন, তা কেউই শিশু নন ! পঁচিশোর্ধতো বটেই !  

    তাই আগে শিষ্টতা শিখি, আদব শিখি; তারপর না হয় আধুনিক হই  ।।


    #শৌচাগারব্যবহারেসচেতন_হই


  • Parenting

    সন্তানের দেখাশোনা

    আমাদের দেশে বেশীরভাগ অভিভাবক; বিশেষত বাবারা যখন তাঁর সন্তানদের শাসন করেন, তখন কিভাবে করেন ?

    ১. প্রথমেই নিজের অবস্থান তুলে ধরেন, তা তিনি যেই অবস্থানেই থাকুন না কেনো !
    ২. তারপর তাঁর অতীতের কথা তুলে ধরেন, তিনি কিভাবে এ পর্যায়ে এসেছেন, কতোটা কষ্ট করেছেন ইত্যাদি ।
    ৩. অতঃপর তাঁর সন্তানের ভাগ্যের সুপ্রশংসা করেন। তাঁর সন্তান এতোটা ভাগ্যবান যে তাঁর ছায়া সন্তানটির মাথার উপর আছে, অন্যদিকে তিনি নিজে যোগ্য অভিভাবকহীন দশায় কতোটা অসহায় অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সন্তানকে সে সব কাহিনী শোনান এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে বলেন ।
    ৪. তারপর আসেন তুলনাতে, তিনি কি পাননি, সন্তান কে কি দিয়েছেন; এ সকল নিকেশে ।
    ৫. শেষ পর্যায়ে সন্তানের বর্তমান অবস্থা ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন এবং তা নিয়ে আচার-বিচার শুরু করেন।  এই আচার-বিচারের প্রাথমিক পর্যায়ে সন্তানকে এই বোধে বোধিত করা হয় যে সে কত বড় অকালকুষ্মান্ড। তার বয়েসে তাঁর বাবা কি না করেছেন আর সে  কি করছে ! কিভাবে সে তার বাবার অন্ন ধ্বংস করছে । আর সেই অন্ন যোগাতে বাবা  কে কতোটা কষ্ট করতে হচ্ছে । এরপর আসেন এমুক সাহেব তমুক সাহেবের সন্তানদের কথা, সে সন্তান যদি সন্ত্রাসীও হয়, তবে সে কত বড় সন্ত্রাসী নিজের সন্তানের সামনে তা তুলে ধরা হয় । 

    সবশেষে সন্তানকে বলা হয় সে যেনো তার জীবনের ব্যাপারে ভালো কোন সিদ্ধান্ত নেয়। কিভাবে সে তার নিয়তিকে সুপ্রসন্ন করবে সে ব্যাপারে যেনো সে এখন থেকেই ভাবে। যথাসময়ে সে যেনো পরিবারের দায়িত্ব তুলে নিতে পারে ।

    এই নাতীদীর্ঘ বক্তব্যের ফলাফল আদৌ কি হলো ! কীর্তন শোনার মত করে সন্তান শুনল, বুঝে-না বুঝে মাথা নাড়ল । বাবার সামনে থেকে চলে আসার পর হাফ ছেড়ে বাঁচল এবং সবশেষে বন্ধুদের কাছে ব্যঙ্গ করে পুরো ব্যাপারটার সারাংশ বলল ।

    এই সন্তানই যখন খুব বিপদে পরে তখন কিন্তু সে তাঁর মাথার উপর সেই ছায়াবিষ্ট পিতাকে পাশে পায় না, এমন কি পায় না তার পরিরের কাউকেই ! পরিবারে প্রতি দায়বদ্ধতা, সমাজে তার পরিবারের সম্মানহানির ভয়, বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা সবকিছু মিলিয়ে সে নিজেই নিজের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করে, বন্ধুদের কাছে আশ্রয় নেয়, যা বেশীর ভাগ সময় সুফল থেকে কুফলই বয়ে আনে।

    এদেশে বিশ থেকে আটাশ বছর বয়েসী ছেলে মেয়েদের মতন অসহায় আর হয় না। তারা না পারে নিজেরা নিজেদের বুঝতে, না পারে অন্যকে বোঝতে । 
    যেখানে পরিবারকে পাশে পাওয়ার কথা, সেখানে পরিবার থেকেই তারা সবচাইতে বেশী মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়। 

    এদেশের বাবাদের মতন ভালো বাবা আর হয় না। তাঁরা নিজেরা তাঁদের পুরো জীবনটাই সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে দেন। কিন্তু বিনিময়ে তাঁরা সন্তানের কাছে সেই সন্তানের পুরো জীবনটাই চেয়ে বসেন। খুব কম বাবাই আছেন যারা সন্তানের দুঃসময়ে, সন্তানের বিপদে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে মনে সাহস যোগান, একসাথে লড়ার প্রতিশ্রুতি দেন ।

    এদেশের বাবারা বোঝেন না, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই জীবনের সবকিছু না। কাঁধে আলতো করে রাখা ভরসার হাতটিই একজন মানুষের জীবনের সবকিছু বদলে দিতে পারে ।


  • Awarness

    সামাজিক সচেতনতা ও আমাদের করনীয়

    সহজাতভাবে সমাজে আমরা অনেকেই "প্রিভিলেজড" বা সুবিধাপ্রাপ্ত, ক্ষেত্রবিশেষে আমরা অনেকে আবার "বিশেষভাবে" সুবিধাপ্রাপ্ত ! অন্যদিকে, জন্মগতভাবেই অনেকেই আমরা বঞ্চিত, ভীষণভাবে বঞ্চিত।
    শিক্ষিত-স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার দরুন দেখা যায় মেধাবী না হওয়া সত্ত্বেও অনেকেরই ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সৌভাগ্য হয়, ইদানীং প্রচুর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এই সংখ্যাটাও বেড়েছে বেশ। যারা এ সকল জায়গায় পড়াশুনা করেন সমাজে তাদের কদরই আলাদা! অপরদিকে, বাবা-মা বিত্তহীন-শিক্ষাহীন কিংবা সমাজের চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হওয়ার দরুণ মেধাবি হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই প্রাথমিকশিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হন।

    এদিকে, চতুর্থ শ্রেণির নাগরিকগণের সন্তানদের প্রথম শ্রেণির নাগরিক পদে উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যেনো আমরা মেনেই নিতে পারি না! তাইতো আমাদের সাংবাদিক ভাই-বোনেরা তাঁদের সংবাদপত্রে লেখেন, "রিক্সাচালক পিতার ঘরে ম্যাজিস্ট্রেট কন্যা", "কৃষকের সন্তান হয়েও সারাদেশে মেডিকেল পরীক্ষায় প্রথম হলেন এমুক" ইত্যাদি ইত্যাদি  ! 
    তার মানে আমরা ধরেই নেই ডাক্তারের ছেলে কিংবা মেয়েই ডাক্তার হবে! তাই ডাক্তারের সন্তান মেডিকেল পরীক্ষায় প্রথম হলে নিউজ হয় না, আমরা মেনেই নেই এটি স্বাভাবিক। কিন্তু কৃষকের সন্তান প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হলে, প্রতিযোগিতামূলক কোনো পরীক্ষায় প্রথম হলেই আমাদের টনক নড়ে ওঠে, আমরা নড়েচড়ে বসে মানুষগুলোকে ছোট করে নিজেদের আঙ্গিকে গল্প বানাই আর নাম দেই; অনুপ্রেরণার গল্প-মানবিকতার গল্প ! অনেকটা "জুতা মেরে গরু দান" করার মতন ! 

    এ সমাজে "আমার-আপনার" বলে আদৌ আছে কি কিছু? প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী এ সমাজের সকলকিছুই "আমাদের"। তাই এ সমাজে জন্মগতভাবে সুবিধা পেয়ে, ভাগ্যগুণে 'বাবু' সাজতে পেরে সমাজে পশ্চাদপদদের অপমান করার কোনো অধিকার আমাদের কারোরই নেই। 
    একজন রিক্সাচালকের সাথে আমাদের আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কি? যিনি রিক্সা চালাচ্ছেন, বাসের হেল্পার হয়েছেন, টেম্পু চালাচ্ছেন, লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাজাঘষার কাজ করছেন তার পিতা, পিতার পিতা হয়ত এতই গরীব ছিলেন যে তিনি সুশিক্ষা লাভ করার মতন পর্যাপ্ত পরিবেশ পাননি বিধায় তাকে এরকম কাজ করতে হচ্ছে (যদিও সমাজে কোনো কাজই ছোট নয়)।
    ভাগ্যের পৃষ্ঠতলে নিষ্পেষিত হয়ে যেই জন সমাজে প্রচলিত প্রথানুযায়ী "ছোট" কাজ করছেন, কেনো আমরা তাঁকে তার পর্যাপ্ত সম্মান দিবো না? কেনো আমরা "অর্থ-শিক্ষা-সামাজিক অবস্থান" ইত্যাদি ভ্রান্ত বিষয়গুলোকে নির্ণায়ক ধরে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈয়ার করি? 

    মানুষে মানুষে বিভেদ হোউক "আচার-ব্যবহার-ভদ্রতা-শিষ্টাচার" ইত্যাদির নিরিখে, একই সাথে অর্থবিত্ত-শিক্ষা-সামাজিক স্টেটাস এ সকল মানদণ্ড বিলুপ্ত হয়ে সমাজের প্রতিটি মানুষ যার যার নিজের মানবিক যোগ্যতানুযায়ী সম্মানিত হোউন এ সমাজে। 


  • Awarness

    পেশাজীবী মায়েদের জন্য সরকারি বেসরকারি দপ্তরে ‘দিবাযত্ন কেন্দ্র’ স্থাপন জরুরি অভিমত

    একজন চাকুরিজীবী বিবাহিত নারী যখন জানেন যে তিনি মা হতে চলেছেন, তখন তার সেই বাঁধভাঙ্গা আনন্দের সাথে যোগ হয় রাজ্যের দুশ্চিন্তা! আর দুশ্চিন্তা হবেই বা না কেনো! এদেশে একজন নারী যখন বউ হোন এবং পরবর্তীতে মা হোন তখন সমাজ-পরিবার মিলেমিশে সেই নারীকে বেধে ফেলে নানান ভ্রান্ত বিধি নিষেধের বেড়াজালে, একই সাথে দিকপাশ না ভেবেই তার গলায় জড়িয়ে দেওয়া হয় দায়িত্ব-কর্তব্যের মালা! সেক্ষেত্রে মা হতে চলেছেন এমন একজন নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তোলে সমাজ এবং পরিবার, কারণ অলিখিতভাবে সমাজ এটি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে সন্তানের দায়িত্ব বরাবরই মায়ের উপরই বর্তায়। যেহেতু প্রকৃতির বিধান মতে সন্তান বেড়ে ওঠে মায়ের গর্ভেই এবং সদ্যোজাত সন্তানের একমাত্র খাবার হয় মায়ের বুকের দুধ, তাই সমাজ তার সেই অযৌক্তিক-অন্যায় বিধানটি খুব সহজেই মহাসমারোহে মায়েদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। তাই একজন নারীর মা হওয়ার প্রাথমিকাবস্থার সময়গুলো হয়ে ওঠে তীব্র যন্ত্রণার, কারো কারো ক্ষেত্রে আবার মা হওয়ার পুরো যাত্রাটাই হয়ে ওঠে দুঃসহ বেদনার। তা সে যা বলছিলাম; একজন চাকুরিজীবী বিবাহিত নারী যখন জানেন যে তিনি মা হতে চলেছেন, তখন তিনি ভাবনায় পরে যান মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে যখন তিনি কর্মস্থলে যোগ দেবেন তখন তার দুধের শিশুটির দেখভাল কে করবে! কার কাছে রেখে যাবেন তিনি তার মাত্র মাস সাতেকের শিশু সন্তানটিকে! একেবারেই হাতে গোনা ক’জন নারী আছেন যারা এ সময়টাতে পরিবারকে পাশে পান, পরিবারের সমর্থন ও সহায়তা পান। কিন্তু বেশিরভাগ নারীর জন্যেই জীবন হয়ে ওঠে নিরতিশয় সংগ্রাম ও অসহায়ত্বের।
    সহায়তা ও সমর্থনের বিপরীতে সমাজ ও পরিবার কর্মজীবী মায়েদের দিকে আঙ্গুল তোলে, নানান কটু কথা আর নতুন মা হওয়া নারীর গায়ে স্বার্থপরের তকমা লাগিয়ে তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মজীবী মায়েরা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের উজ্জ্বল পেশাজীবনের ইতি ঘটিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোকে বিসর্জন দিয়ে দেন।
    কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! একজন শিক্ষিত পেশাজীবী নারীর ‘ক্যারিয়ার’ও তার নিজ সন্তানের মতনই দামী। বেশিরভাগ নারীই যখন নানান প্রতিকূলতা আর কাঠখড় পুড়িয়ে নিজের শিক্ষা জীবনটি অতিবাহিত করেন, তখনই তিনি নিজের পেশাজীবন নিয়ে স্বপ্ন বোনা শুরু করেন, এবং একসময় অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। এক্ষেত্রে যেই নারীকে তার যুগের পর যুগ যাপন করে বোনা সেই স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়, একমাত্র তিনিই জানেন সেই আঘাতটা ঠিক কেমন! এই আঘাত সন্তান হারানোর আঘাতের মতনই তীব্র, এই ব্যথা ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যথার মতনই তীক্ষ্ণ! আর যেই মা শত বাধা-বিপত্তি, পরিবার-সমাজের রাঙানো চোখ, প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগ দেন এবং নিজের ছোট্ট শিশুটিকে পরিবারের বাইরে গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে নিজের পেশাজীবনকে এগিয়ে নিয়ে যান, সেই মা’ই জানেন হৃদয়ে ঠিক কেমন কাঁচ কাটা ব্যথাটা লাগে, সেই ব্যথা সে মা ছাড়া কখনই কেউ সমানুভূতি দিয়ে অনুভব করতে পারবে না। কর্মজীবী মায়েদের যেনো কষ্টের শেষ নেই, কর্মজীবী মায়েদের যেনো শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণার শেষ নেই। অথচ রাষ্ট্র চাইলেই কর্মজীবী মায়েদের এমন উভয় সংকটাপন্ন জীবন থেকে নিস্তার দিতে পারে, রাষ্ট্র চাইলেই মায়েদের কষ্ট লাঘব করতে পারে। কিভাবে?
    প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে বাধ্যতামূলক ‘ডে কেয়ার’ বা ‘দিবাযত্ন কেন্দ্র’ এর ব্যবস্থা করা হোক। এক্ষেত্রে কেবল কর্মজীবী মায়েরাই নন, স্বস্তি পাবেন বাবারাও। অনেক সময়ই সন্তানের মায়ের অসুস্থতার কারণে বা পারিবারিক যেকোনো সংকটে সন্তানের সম্পূর্ণ দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয় বাবাকেই। কর্মস্থলের দিবাযত্ন কেন্দ্র স্বাচ্ছন্দ্য দেবে সেই দিশেহারা বাবাকেও।
    সন্তানের দায়িত্ব মা নাকি বাবার সে বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের ভাবতে হবে সমস্যার সমাধান নিয়ে। কেবল মায়েরা নন, সন্তানের দায়িত্ব সমানভাবে সন্তানের বাবারতো অবশ্যই। তাই মা-বাবা দুজনেই যেনো নির্বিঘ্নে নিজের পেশাজীবনে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিশ্চিন্তভাবে সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন তাই প্রতিটি দপ্তরে বাধ্যতামূলক ‘ডে কেয়ার’ বা ‘দিবাযত্ন কেন্দ্র’ স্থাপন করা অত্যধিক জরুরি। সেটি পরিচালনার জন্যে আলাদা বাজেট থাকতে পারে, কিংবা বাবা-মায়েরা নিজেদের পারিশ্রমিকের একাংশ দিয়েও তা পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু প্রারম্ভিক পদক্ষেপটি নিতে হবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই। আর এই আওয়াজ উঠুক এখনই।