আমাদের দেশে বেশীরভাগ অভিভাবক; বিশেষত বাবারা যখন তাঁর সন্তানদের শাসন করেন, তখন কিভাবে করেন ?
১. প্রথমেই নিজের অবস্থান তুলে ধরেন, তা তিনি যেই অবস্থানেই থাকুন না কেনো !
২. তারপর তাঁর অতীতের কথা তুলে ধরেন, তিনি কিভাবে এ পর্যায়ে এসেছেন, কতোটা কষ্ট করেছেন ইত্যাদি ।
৩. অতঃপর তাঁর সন্তানের ভাগ্যের সুপ্রশংসা করেন। তাঁর সন্তান এতোটা ভাগ্যবান যে তাঁর ছায়া সন্তানটির মাথার উপর আছে, অন্যদিকে তিনি নিজে যোগ্য অভিভাবকহীন দশায় কতোটা অসহায় অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সন্তানকে সে সব কাহিনী শোনান এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে বলেন ।
৪. তারপর আসেন তুলনাতে, তিনি কি পাননি, সন্তান কে কি দিয়েছেন; এ সকল নিকেশে ।
৫. শেষ পর্যায়ে সন্তানের বর্তমান অবস্থা ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন এবং তা নিয়ে আচার-বিচার শুরু করেন। এই আচার-বিচারের প্রাথমিক পর্যায়ে সন্তানকে এই বোধে বোধিত করা হয় যে সে কত বড় অকালকুষ্মান্ড। তার বয়েসে তাঁর বাবা কি না করেছেন আর সে কি করছে ! কিভাবে সে তার বাবার অন্ন ধ্বংস করছে । আর সেই অন্ন যোগাতে বাবা কে কতোটা কষ্ট করতে হচ্ছে । এরপর আসেন এমুক সাহেব তমুক সাহেবের সন্তানদের কথা, সে সন্তান যদি সন্ত্রাসীও হয়, তবে সে কত বড় সন্ত্রাসী নিজের সন্তানের সামনে তা তুলে ধরা হয় ।
সবশেষে সন্তানকে বলা হয় সে যেনো তার জীবনের ব্যাপারে ভালো কোন সিদ্ধান্ত নেয়। কিভাবে সে তার নিয়তিকে সুপ্রসন্ন করবে সে ব্যাপারে যেনো সে এখন থেকেই ভাবে। যথাসময়ে সে যেনো পরিবারের দায়িত্ব তুলে নিতে পারে ।
এই নাতীদীর্ঘ বক্তব্যের ফলাফল আদৌ কি হলো ! কীর্তন শোনার মত করে সন্তান শুনল, বুঝে-না বুঝে মাথা নাড়ল । বাবার সামনে থেকে চলে আসার পর হাফ ছেড়ে বাঁচল এবং সবশেষে বন্ধুদের কাছে ব্যঙ্গ করে পুরো ব্যাপারটার সারাংশ বলল ।
এই সন্তানই যখন খুব বিপদে পরে তখন কিন্তু সে তাঁর মাথার উপর সেই ছায়াবিষ্ট পিতাকে পাশে পায় না, এমন কি পায় না তার পরিরের কাউকেই ! পরিবারে প্রতি দায়বদ্ধতা, সমাজে তার পরিবারের সম্মানহানির ভয়, বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা সবকিছু মিলিয়ে সে নিজেই নিজের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করে, বন্ধুদের কাছে আশ্রয় নেয়, যা বেশীর ভাগ সময় সুফল থেকে কুফলই বয়ে আনে।
এদেশে বিশ থেকে আটাশ বছর বয়েসী ছেলে মেয়েদের মতন অসহায় আর হয় না। তারা না পারে নিজেরা নিজেদের বুঝতে, না পারে অন্যকে বোঝতে ।
যেখানে পরিবারকে পাশে পাওয়ার কথা, সেখানে পরিবার থেকেই তারা সবচাইতে বেশী মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়।
এদেশের বাবাদের মতন ভালো বাবা আর হয় না। তাঁরা নিজেরা তাঁদের পুরো জীবনটাই সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে দেন। কিন্তু বিনিময়ে তাঁরা সন্তানের কাছে সেই সন্তানের পুরো জীবনটাই চেয়ে বসেন। খুব কম বাবাই আছেন যারা সন্তানের দুঃসময়ে, সন্তানের বিপদে তার কাঁধে হাত রেখে তাকে মনে সাহস যোগান, একসাথে লড়ার প্রতিশ্রুতি দেন ।
এদেশের বাবারা বোঝেন না, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই জীবনের সবকিছু না। কাঁধে আলতো করে রাখা ভরসার হাতটিই একজন মানুষের জীবনের সবকিছু বদলে দিতে পারে ।