একজন চাকুরিজীবী বিবাহিত নারী যখন জানেন যে তিনি মা হতে চলেছেন, তখন তার সেই বাঁধভাঙ্গা আনন্দের সাথে যোগ হয় রাজ্যের দুশ্চিন্তা! আর দুশ্চিন্তা হবেই বা না কেনো! এদেশে একজন নারী যখন বউ হোন এবং পরবর্তীতে মা হোন তখন সমাজ-পরিবার মিলেমিশে সেই নারীকে বেধে ফেলে নানান ভ্রান্ত বিধি নিষেধের বেড়াজালে, একই সাথে দিকপাশ না ভেবেই তার গলায় জড়িয়ে দেওয়া হয় দায়িত্ব-কর্তব্যের মালা! সেক্ষেত্রে মা হতে চলেছেন এমন একজন নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তোলে সমাজ এবং পরিবার, কারণ অলিখিতভাবে সমাজ এটি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে সন্তানের দায়িত্ব বরাবরই মায়ের উপরই বর্তায়। যেহেতু প্রকৃতির বিধান মতে সন্তান বেড়ে ওঠে মায়ের গর্ভেই এবং সদ্যোজাত সন্তানের একমাত্র খাবার হয় মায়ের বুকের দুধ, তাই সমাজ তার সেই অযৌক্তিক-অন্যায় বিধানটি খুব সহজেই মহাসমারোহে মায়েদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। তাই একজন নারীর মা হওয়ার প্রাথমিকাবস্থার সময়গুলো হয়ে ওঠে তীব্র যন্ত্রণার, কারো কারো ক্ষেত্রে আবার মা হওয়ার পুরো যাত্রাটাই হয়ে ওঠে দুঃসহ বেদনার। তা সে যা বলছিলাম; একজন চাকুরিজীবী বিবাহিত নারী যখন জানেন যে তিনি মা হতে চলেছেন, তখন তিনি ভাবনায় পরে যান মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে যখন তিনি কর্মস্থলে যোগ দেবেন তখন তার দুধের শিশুটির দেখভাল কে করবে! কার কাছে রেখে যাবেন তিনি তার মাত্র মাস সাতেকের শিশু সন্তানটিকে! একেবারেই হাতে গোনা ক’জন নারী আছেন যারা এ সময়টাতে পরিবারকে পাশে পান, পরিবারের সমর্থন ও সহায়তা পান। কিন্তু বেশিরভাগ নারীর জন্যেই জীবন হয়ে ওঠে নিরতিশয় সংগ্রাম ও অসহায়ত্বের।
সহায়তা ও সমর্থনের বিপরীতে সমাজ ও পরিবার কর্মজীবী মায়েদের দিকে আঙ্গুল তোলে, নানান কটু কথা আর নতুন মা হওয়া নারীর গায়ে স্বার্থপরের তকমা লাগিয়ে তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মজীবী মায়েরা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের উজ্জ্বল পেশাজীবনের ইতি ঘটিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোকে বিসর্জন দিয়ে দেন।
কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না! একজন শিক্ষিত পেশাজীবী নারীর ‘ক্যারিয়ার’ও তার নিজ সন্তানের মতনই দামী। বেশিরভাগ নারীই যখন নানান প্রতিকূলতা আর কাঠখড় পুড়িয়ে নিজের শিক্ষা জীবনটি অতিবাহিত করেন, তখনই তিনি নিজের পেশাজীবন নিয়ে স্বপ্ন বোনা শুরু করেন, এবং একসময় অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। এক্ষেত্রে যেই নারীকে তার যুগের পর যুগ যাপন করে বোনা সেই স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয়, একমাত্র তিনিই জানেন সেই আঘাতটা ঠিক কেমন! এই আঘাত সন্তান হারানোর আঘাতের মতনই তীব্র, এই ব্যথা ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যথার মতনই তীক্ষ্ণ! আর যেই মা শত বাধা-বিপত্তি, পরিবার-সমাজের রাঙানো চোখ, প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে কর্মস্থলে যোগ দেন এবং নিজের ছোট্ট শিশুটিকে পরিবারের বাইরে গৃহপরিচারিকার কাছে রেখে নিজের পেশাজীবনকে এগিয়ে নিয়ে যান, সেই মা’ই জানেন হৃদয়ে ঠিক কেমন কাঁচ কাটা ব্যথাটা লাগে, সেই ব্যথা সে মা ছাড়া কখনই কেউ সমানুভূতি দিয়ে অনুভব করতে পারবে না। কর্মজীবী মায়েদের যেনো কষ্টের শেষ নেই, কর্মজীবী মায়েদের যেনো শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রণার শেষ নেই। অথচ রাষ্ট্র চাইলেই কর্মজীবী মায়েদের এমন উভয় সংকটাপন্ন জীবন থেকে নিস্তার দিতে পারে, রাষ্ট্র চাইলেই মায়েদের কষ্ট লাঘব করতে পারে। কিভাবে?
প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে বাধ্যতামূলক ‘ডে কেয়ার’ বা ‘দিবাযত্ন কেন্দ্র’ এর ব্যবস্থা করা হোক। এক্ষেত্রে কেবল কর্মজীবী মায়েরাই নন, স্বস্তি পাবেন বাবারাও। অনেক সময়ই সন্তানের মায়ের অসুস্থতার কারণে বা পারিবারিক যেকোনো সংকটে সন্তানের সম্পূর্ণ দেখভালের দায়িত্ব নিতে হয় বাবাকেই। কর্মস্থলের দিবাযত্ন কেন্দ্র স্বাচ্ছন্দ্য দেবে সেই দিশেহারা বাবাকেও।
সন্তানের দায়িত্ব মা নাকি বাবার সে বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের ভাবতে হবে সমস্যার সমাধান নিয়ে। কেবল মায়েরা নন, সন্তানের দায়িত্ব সমানভাবে সন্তানের বাবারতো অবশ্যই। তাই মা-বাবা দুজনেই যেনো নির্বিঘ্নে নিজের পেশাজীবনে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিশ্চিন্তভাবে সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন তাই প্রতিটি দপ্তরে বাধ্যতামূলক ‘ডে কেয়ার’ বা ‘দিবাযত্ন কেন্দ্র’ স্থাপন করা অত্যধিক জরুরি। সেটি পরিচালনার জন্যে আলাদা বাজেট থাকতে পারে, কিংবা বাবা-মায়েরা নিজেদের পারিশ্রমিকের একাংশ দিয়েও তা পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু প্রারম্ভিক পদক্ষেপটি নিতে হবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই। আর এই আওয়াজ উঠুক এখনই।