সহজাতভাবে সমাজে আমরা অনেকেই "প্রিভিলেজড" বা সুবিধাপ্রাপ্ত, ক্ষেত্রবিশেষে আমরা অনেকে আবার "বিশেষভাবে" সুবিধাপ্রাপ্ত ! অন্যদিকে, জন্মগতভাবেই অনেকেই আমরা বঞ্চিত, ভীষণভাবে বঞ্চিত।
শিক্ষিত-স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার দরুন দেখা যায় মেধাবী না হওয়া সত্ত্বেও অনেকেরই ভালো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সৌভাগ্য হয়, ইদানীং প্রচুর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এই সংখ্যাটাও বেড়েছে বেশ। যারা এ সকল জায়গায় পড়াশুনা করেন সমাজে তাদের কদরই আলাদা! অপরদিকে, বাবা-মা বিত্তহীন-শিক্ষাহীন কিংবা সমাজের চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হওয়ার দরুণ মেধাবি হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই প্রাথমিকশিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হন।
এদিকে, চতুর্থ শ্রেণির নাগরিকগণের সন্তানদের প্রথম শ্রেণির নাগরিক পদে উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই যেনো আমরা মেনেই নিতে পারি না! তাইতো আমাদের সাংবাদিক ভাই-বোনেরা তাঁদের সংবাদপত্রে লেখেন, "রিক্সাচালক পিতার ঘরে ম্যাজিস্ট্রেট কন্যা", "কৃষকের সন্তান হয়েও সারাদেশে মেডিকেল পরীক্ষায় প্রথম হলেন এমুক" ইত্যাদি ইত্যাদি !
তার মানে আমরা ধরেই নেই ডাক্তারের ছেলে কিংবা মেয়েই ডাক্তার হবে! তাই ডাক্তারের সন্তান মেডিকেল পরীক্ষায় প্রথম হলে নিউজ হয় না, আমরা মেনেই নেই এটি স্বাভাবিক। কিন্তু কৃষকের সন্তান প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হলে, প্রতিযোগিতামূলক কোনো পরীক্ষায় প্রথম হলেই আমাদের টনক নড়ে ওঠে, আমরা নড়েচড়ে বসে মানুষগুলোকে ছোট করে নিজেদের আঙ্গিকে গল্প বানাই আর নাম দেই; অনুপ্রেরণার গল্প-মানবিকতার গল্প ! অনেকটা "জুতা মেরে গরু দান" করার মতন !
এ সমাজে "আমার-আপনার" বলে আদৌ আছে কি কিছু? প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী এ সমাজের সকলকিছুই "আমাদের"। তাই এ সমাজে জন্মগতভাবে সুবিধা পেয়ে, ভাগ্যগুণে 'বাবু' সাজতে পেরে সমাজে পশ্চাদপদদের অপমান করার কোনো অধিকার আমাদের কারোরই নেই।
একজন রিক্সাচালকের সাথে আমাদের আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কি? যিনি রিক্সা চালাচ্ছেন, বাসের হেল্পার হয়েছেন, টেম্পু চালাচ্ছেন, লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাজাঘষার কাজ করছেন তার পিতা, পিতার পিতা হয়ত এতই গরীব ছিলেন যে তিনি সুশিক্ষা লাভ করার মতন পর্যাপ্ত পরিবেশ পাননি বিধায় তাকে এরকম কাজ করতে হচ্ছে (যদিও সমাজে কোনো কাজই ছোট নয়)।
ভাগ্যের পৃষ্ঠতলে নিষ্পেষিত হয়ে যেই জন সমাজে প্রচলিত প্রথানুযায়ী "ছোট" কাজ করছেন, কেনো আমরা তাঁকে তার পর্যাপ্ত সম্মান দিবো না? কেনো আমরা "অর্থ-শিক্ষা-সামাজিক অবস্থান" ইত্যাদি ভ্রান্ত বিষয়গুলোকে নির্ণায়ক ধরে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈয়ার করি?
মানুষে মানুষে বিভেদ হোউক "আচার-ব্যবহার-ভদ্রতা-শিষ্টাচার" ইত্যাদির নিরিখে, একই সাথে অর্থবিত্ত-শিক্ষা-সামাজিক স্টেটাস এ সকল মানদণ্ড বিলুপ্ত হয়ে সমাজের প্রতিটি মানুষ যার যার নিজের মানবিক যোগ্যতানুযায়ী সম্মানিত হোউন এ সমাজে।