পাহাড়, ঝরনা, গিরিপথ—চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সবই আছে। নেই শুধু একটা নদী। তবে আছে নদীভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান—হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। জীববিজ্ঞান অনুষদের তৃতীয় তলায় অবস্থিত এই ল্যাবরেটরিতে নদী নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা, সবই চলে। গবেষণাগার হওয়ার আগে জায়গাটা ছিল পরিত্যক্ত, ব্যবহারের অযোগ্য। পরে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মনজুরুল কিবরীয়ার প্রচেষ্টা এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পিকেএসএফ ও আইডিএফের সহযোগিতায় ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এই গবেষণাগার।

কী কাজ, কী অর্জন

গত ২৮ মে গবেষণাগারে পা রেখে দেখা গেল, পুরো জায়গাটি তিনটি অংশে বিভক্ত। শুরুতেই আধুনিক মিনি ডিজিটাল কনফারেন্স সেন্টার, যেখানে একসঙ্গে ৫০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে। বৈজ্ঞানিক আলোচনা থেকে শুরু করে ভিডিও-তথ্যচিত্র প্রদর্শন, সব এখানেই হয়। দ্বিতীয় অংশের নাম নদী জাদুঘর ও সংরক্ষণাগার। এটি মূলত বৈজ্ঞানিক গবেষণার—বিভিন্ন নথি, প্রকাশিত প্রবন্ধ ও প্রকল্পের কাগজপত্রের সংগ্রহশালা। হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘গাঙ্গেয় ডলফিনের কঙ্কালগুলো বাক্সে আছে, বড় মাছগুলো সংরক্ষণ করা আছে ফ্রিজে। অ্যাকুয়ারিয়াম থাকলে মাছগুলো সেখানে রাখা যেত। সবকিছু আমাদের মাথায় আছে। জায়গার স্বল্পতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে রিভার মিউজিয়াম অংশ আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি না। আর কক্ষের শেষ অংশজুড়ে আছে স্পেশালাইজড ল্যাবরেটরি। যেখানে শিক্ষার্থীরা গবেষণাধর্মী কাজগুলো করে।’

এখন পর্যন্ত কার্প–জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, কালবাউশ ও মৃগেল) ও গাঙ্গেয় ডলফিনের জিন নকশার (জীবনরহস্য উন্মোচন) কাজ করেছে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। চলছে ডলফিন জরিপের কাজ। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনবার জরিপ করা হয়েছে। সর্বশেষ জরিপে জানা গেছে, হালদায় ১৪৭টি ডলফিনের অস্তিত্ব আছে। সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির জন্য একটি মাইলফলক। অধ্যাপক মনজুরুল বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সফল সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা যদি কোথাও কার্যকর থাকে, সেটা হালদায় আছে।’ আরও একটি সুখবর দিলেন তিনি, ‘দূষণ মোকাবিলায় আমরা লন্ডনের টেমস নদীর উদাহরণ টানি। আমরা যদি আবাসিক এলাকার দূষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, তাহলে হালদাকে ৭০-৮০ ভাগ দূষণমুক্ত করতে পারব। তখন লন্ডনের টেমস নদীর সঙ্গে চট্টগ্রামের হালদার নামও উচ্চারিত হবে।’

গবেষণার যথেষ্ট উপাদা আছে এই ল্যাবরেটরিতে
গবেষণার যথেষ্ট উপাদা আছে এই ল্যাবরেটরিতেছবি: সংগৃহীত

শিক্ষার্থীদের গবেষণা

একাডেমিক কাজের অংশ হিসেবে এখন পর্যন্ত ৭৪ শিক্ষার্থী এই গবেষণাগারে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে যুক্ত আছেন ১৬ শিক্ষার্থী। তাঁদেরই একজন আবদুল্লাহ আল আশেক। গবেষণা সহকারী হিসেবে নিযুক্ত এই তরুণ বলেন, ‘একাডেমিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান—দুই–ই জরুরি। ল্যাবে কাজ করার ফলে চতুর্থ বর্ষের আগেই আমি অনেক মৌলিক জ্ঞান পেয়েছি।’ এই ল্যাবে কাজ করে ভালো জায়গায় পৌঁছেছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সুমা আক্তার যেমন ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি পেয়েছেন। শুরুতে স্কটল্যান্ডে, এরপর গ্রিস আর তারপর ফ্রান্সে পড়তে যাবেন তিনি। সুমা বলেন, ‘স্নাতকোত্তরের থিসিস প্রকল্প দিয়ে আমি এখানে কাজ করা শুরু করি। একজন শিক্ষার্থী তাঁর সেরা অভিজ্ঞতাটা এখানে পেতে পারে। কারণ, ল্যাবের সব সুবিধাই আমরা পাই। ল্যাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই বিদেশে পড়তে যাওয়াটা সহজ হয়েছে। একাডেমিক রেজাল্টের চেয়ে এই অভিজ্ঞতাই বেশি কাজে লেগেছ। আমি মনে করি, এখানে কাজ করার সিদ্ধান্ত আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্তগুলোর একটি।’

আছে বৃত্তির ব্যবস্থা

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশই মধ্যবিত্তের সন্তান। পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যস্ত থাকতে হয় টিউশনিতে। এর ওপর গবেষণার কাজে যদি গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয়, অনীহা চলে আসা স্বাভাবিক। এসব বিবেচনায় গবেষণাগারের শিক্ষার্থীদের জন্য একটা বৃত্তির ব্যবস্থাও করেছে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। এনজিও সংস্থা পিকেএসএফ ও আইডিএফের সহায়তায় এটি দেওয়া হয়। অধ্যাপক কিবরীয়া বলেন, ‘এটা বিশেষ কিছু নয়। শিক্ষার্থীরা যেন নির্বিঘ্নে গবেষণা করতে পারে, এ জন্য প্রতিবছর দেড় লাখ টাকার বৃত্তি দেওয়া হয়। এখানে যাঁরা (১৬ জন) কাজ করে, তাঁদের মধ্যে এটা আমরা বণ্টন করে দিই।’

আগামী ৫০ বছর হালদা নদী কীভাবে এগোবে, তার একটি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ইতিমধ্যে প্রস্তুত করেছে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। তবে শুধু হালদা নয়, ভবিষ্যতে গবেষণাগারটিকে বাংলাদেশের নদী গবেষণার একটা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান অধ্যাপক কিবরীয়া। তিনি বলেন, ‘২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমরা হালদায় সীমাবদ্ধ ছিলাম। এবার কর্ণফুলী, সাঙ্গুর দিকে যাচ্ছি। চট্টগ্রামের অন্যান্য নদীর দিকেও এগোব।’

prothom alo