৩৮০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব হলেও মূলত ২৫ লাখ বছর আগে আদি মানুষের বিকাশ লাভ হয় এবং তাদের হাতেই উদ্ভাবিত হয় পাথরের হাতিয়ার। এ সময় পর্যন্ত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিকুলের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। প্রায় ৬ লক্ষ বছর আগে বরফ যুগে মানুষ আগুনের আবিষ্কার ও ব্যবহার শেখার পর মূলত মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রথম বড় রকমের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
সেই আদিকালের বরফযুগ হতে বর্তমান আধুনিক শিল্প সমৃদ্ধ যুগে আসতে মানব প্রজাতিকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। ইতিহাস এমনটাই সাক্ষ্য দেয়।
যে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ইতিহাসকে আজকের অবস্থানে এনে দিয়েছে তার প্রথমটি হলো বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব যা প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসে ভিত্তি স্থাপন করে। এরপর বিকাশ ঘটে কৃষিভিত্তিক বিপ্লবের , যা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে মানুষের ইতিহাসকে দেয় নতুন গতি। এই কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রাণীদের গৃহপালিতকরণ ও আমাদের যাযাবর পূর্বপুরুষেরা এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
স্থায়ীভাবে বসবাসের দীর্ঘ অগ্রযাত্রার পর আজ হতে প্রায় ৫০০ বছর আগে সূচনা হয় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের (ঝপরবহঃরভরপ জবাড়ষঁঃরড়হ)। এই সময় থেকে মানুষ তার অজ্ঞতাকে বুঝতে পারে এবং নজিরবিহীন শক্তি অর্জন করতে শুরু করে। এ সময় ইউরোপীয়রা আমেরিকা (কলম্বাস ১৪৯২) আবিষ্কার করেন এবং সাগর জয় করতে শুরু করে যার ফলে উদ্ভব হয় পুঁজিবাদের।
আবার এই পুঁজিবাদের ধারণার মধ্য দিয়ে মানুষ সম্পদ অর্জন, দাসদাসী ও ভোগ বিলাসের দিকে মনোযোগী হতে শুরু করে, যার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৭৭৬ সালে শিল্প বিপ্লব এর মধ্য দিয়ে।
শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে পরিবার ও সম্প্রদায় পরিণত হয় রাষ্ট্র ও বাজারে। বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে এ সময়ে। আমাদের এখনকার খাদ্যাভাস, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব কিংবা আমাদের যৌনতা এসবই আসলে গড়ে উঠেছে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে উত্তর আধুনিক পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের শিকারি মনের নিয়ত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে।
শিল্প বিপ্লব আমাদের আরো বেশি বস্তুগত সম্পদ দিয়েছে, দীর্ঘায়িত জীবন দিয়েছে, সক্ষমতা দিয়েছে মহাকাশ জয়ের। যা আমরা সেই আগেকার জীবনে পাইনি। কিন্তু একই সঙ্গে এই পরিবর্তিত পরিবেশ আমাদের দিয়েছে একাকিত্ব, হতাশা এবং নানা ধরনের মানসিক চাপ।
যেহেতু আপনিও এই শিল্প বিপ্লবের সুবিধাভোগী আধুনিক যুগের একজন সফল মানুষ তাই এই মানসিক চাপ ও চাহিদার অসামঞ্জস্যতা আপনার জীবনেরও অনুসঙ্গ। আপনি চাইলেই এই মানসিক চাপ বাদ দিয়ে জীবন যাপন করতে পারবেন না এবং একমত হবেন এই মানসিক চাপ শুধুমাত্র আমাদের কারো নিজের কর্মের জন্য আমাদের কাছে আসেনি। এটাই যুগ ও সভ্যতা উন্নয়নের বাস্তবতা মাত্র। ##################
মাথা (মগজ) যত বড় স্ট্রেস ততো বেশি
দৈহিক গঠনের অনুপাতে মানুষের মস্তিষ্কের আকার অন্য যে কোন প্রাণীর থেকে বেশ বড়। সাধারণত ৬০ কেজি ওজনের একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক গড়পড়তায় ২০০ ঘন সেন্টিমিটার হয়। অন্যদিকে প্রায় আড়াই লাখ বছর আগের আধা মানুষের মস্তিষ্কের আকারও ছিল প্রায় ৬০০ ঘন সেন্টিমিটার। বর্তমানে আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আকার প্রায় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ ঘন সেন্টিমিটার। শুধু মানুষ নয়, অস্ট্রাকোডার্ম নামের মাছদের পূর্বপুরুষরাও বিশাল আকৃতির স্থুল মস্তিষ্কের দৌলতেই ওরা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেকালের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী। ছুঁচালো মুখ আর চোয়ালহীন ঐ অদ্ভুত প্রাণীগুলিই প্রায় সাড়ে সাত কোটি বছর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে রাজত্ব করেছে আজকের দিনের মানুষের মতোই শুধুমাত্র বৃহৎ মস্তিষ্কের কারণেই।
আমরা জানি কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য কোন প্রাণীকে এ জগতে টিকে থাকার জন্য বেশি সুবিধা দেয়। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ কথা মনে হতেই পারে যে, মাথা বড়ো মানে বেশি বুদ্ধি, বেশি চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ এবং বেশি চিন্তা-ভাবনা করতে পারলে সমাজে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু বাস্তবে এই বড়ো আকারের মগজ শুধু নিরবিচ্ছিন্ন সুবিধাই দেয় না, সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম সমস্যা ও সংকটেরও সৃষ্টি করে। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক দেহের মোট ওজনের ২-৩ শতাংশ। কিন্তু মানুষ যখন ঘুমায় তখন দেহের মোট শক্তির শতকরা ২৫ ভাগ শুধু মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্যই ব্যয় হয়। অন্যদিকে বিশ্রামকালীন অন্যান্য প্রাণীর মস্তিষ্ক পরিচালনার জন্য দেহের মোট শক্তির মাত্র ৮ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।
এই বৃহৎ মস্তিষ্কের কারণে মানুষ নিজেদের দ্রুত সময়ে অন্য প্রাণীদের চেয়ে আলাদা করতে পেরেছে, উন্নত করতে পেরেছে, পাশাপাশি অন্য প্রাণীদের চেয়ে চিন্তা চেতনা ও জীবন পদ্ধতিতে আলাদা হওয়ার কারণে তার দৈনন্দিন চাহিদা, আশা-আকাঙ্খা ও জীবন যাপনেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই ব্যাপক পরিবর্তনের অনুসঙ্গ হিসেবে আমাদের জীবনাচরণের অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে স্ট্রেসও একটি অনুসঙ্গ হিসেবে যোগ হয়েছে। সন্দেহাতীত ভাবে আপনি যেহেতু মনুষ্য সমাজের একজন সচেতন ও কর্মমুখী মানুষ তাই সঙ্গত কারণেই স্ট্রেস আপনার জীবনসঙ্গী। এ দায় আপনার না হলেও স্ট্রেসের দায়িত্ব আপনাকে নিতেই হবে। আপনি চাইলেও স্ট্রেস হতে দূরে থাকতে পারবেন না। যা আপনার মস্তিষ্কের গঠনের কারণেই আপনি সব প্রাণী থেকে আলাদা আর আপনার স্ট্রেসও তাই অবশ্যম্ভাবী এবং নির্ধারিত।
লেখকের প্রকাশিত কিছু বই সামগ্রী :