রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। সভায় ইউনিটভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা কার্যক্রম সমন্বয় কমিটি গঠন করে তিন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে এ নিয়োগের বিষয়ে পরীক্ষা কমিটির সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার অভিযোগ উঠেছে উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারের বিরুদ্ধে।

ভর্তি পরীক্ষা কমিটি সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় 'এ', 'বি' ও 'সি' ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। 'এ' ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. ইলিয়াছ হোসেনকে। 'বি' ইউনিটের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডীন অধ্যাপক ড. মো. ফরিদুল ইসলাম এবং 'সি' ইউনিটের দায়িত্ব পান জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহিদুল আলম।

তবে এ তিনটি ইউনিটের মধ্যে গতবারের ‘এ' ও 'বি' ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ককে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার নিয়োগের বিষয়ে আপত্তি তোলেন সভায় উপস্থিত ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্যরা। প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও পরে উপাচার্য তাঁর একক ক্ষমতাবলে পুনরায় তাঁদেরকে নিয়োগ দিয়েছেন। তবে এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত প্রথাবিরোধী মনে করছেন কমিটির সদস্যরা।

শিক্ষকদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী প্রতিবছর প্রত্যেকটি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক পদটি পরিবর্তিত হয়ে আসলেও এবার সেটি হয়নি। এ পদে দ্বিতীয়বার কাউকে নিয়োগ দেওয়ার কোনো ঘটনা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয় ১২জন ডিন থাকা সত্ত্বেও এ পদে একই ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার নিয়োগ দেওয়াকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন তাঁরা।
 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয়বারে মতো 'এ' ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ইলিয়াস হোসেকে। তবে গতবারের ভর্তি পরীক্ষায় তাঁর ইউনিটেই ঘটেছে প্রক্সিকাণ্ডের মতো ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় তিনজনকে আটকও করা হয়েছিল।

তবে এ ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয় যখন ‘এ’ ইউনিটের দ্বিতীয় শিফটে ৯২ দশমিক ৭৫ নম্বর পেয়ে প্রক্সিকাণ্ডে আটক হওয়া শিক্ষার্থী প্রথম হয়। পরে ঘটনা জানাজানি হলে ওই শিক্ষার্থীর ফলাফল বাতিল করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন এ ঘটনার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ‘এ’ ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. ইলিয়াছ হোসেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ভর্তি পরীক্ষা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদী বলেন, 'এ' এবং 'বি' ইউনিটে একই কোর্ডিনেটরকে রিপিট করা হয়েছে। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এটাতো ভর্তি কমিটির সিদ্ধান্ত নয়, তাহলে ভর্তি কমিটির সিদ্ধান্ত বলে লিখিত হবে কেন? তখন উপাচার্য জানালেন, এটি প্রশাসনের সিদ্ধান্ত, ভর্তি কমিটির নয়। আমরা (প্রশাসন) রিপোর্ট করছি। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত ভর্তি কমিটির নয়। ভর্তি কমিটির সদস্য হিসেবে এর কোনো দায় আমি গ্রহণ করব না। যদি প্রতি বছর এ পদ পরিবর্তন করার প্রথা থেকে থাকে তাহলে প্রশাসনের সে প্রথা ভাঙা উচিত নয় বলে মনে করেন এ অধ্যাপক।

ভর্তি পরিক্ষা কমিটির আরেক সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) পরিচালক অধ্যাপক ড. জিন্নাত আরা বেগম। তিনি বলেন, প্রতি বছরই ইউনিটগুলোর প্রধান সমন্বয়ক পরিবর্তন হয়ে আসছে। তবে এইবার সেটি হয়নি। এবার হয়তো কর্তৃপক্ষ মনে করেছেন যে এভাবে হলেই ভালো হবে। সেজন্যই হয়তো এমনটি করা হয়েছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, প্রতি বছর ‘বি’ ইউনিটে প্রধান সমন্বয়কের পদটি একবার আইবিএ পরিচালক পান ও অন্যবার পান ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের ডিন। গত বছর হয়েছেন ব্যবসা শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদুল ইসলাম। কিন্তু এবার আইবিএ-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. জিন্নাত আরা বেগমকে প্রধান সমন্বয়ক করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা ঘটেনি। কারণ উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তারের সাথে বনিবনা না থাকায় তিনি প্রচলিত নিয়ম ভেঙে একই ব্যক্তিকে পুনরায় নিয়োগ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে ‘এ’ ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা বিষয়ক সাব-কমিটিতে আমরা উপাচার্য মহোদয়কে তিনটি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কের নাম মূল কমিটিতে প্রস্তাবের কথা বলেছিলাম। এরপর তিনি (উপাচার্য) ভর্তি পরীক্ষার মূল কমিটির সভায় তিনটি নাম প্রস্তাব করেন। সভায় নিয়ে সবার আলোচনার ভিত্তিতেই তিনটি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়বার নিয়োগ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়বার ইউনিটের চীফ কো-অডিনেটর নিয়োগ এর আগে অনেকবার হয়েছে। কলা অনুষদের ডিন পরপর দুইবার এই দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিনও পরপর দুইবার দায়িত্ব পালন করেছেন। কে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পেল কী পেল না, এসব কোনো বিষয় নয়। ভর্তি পরীক্ষা সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করাটাই হলো মূল বিষয়।’

তবে পরপর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফজলুল হক বলেন, ‘আমি দু’বার দায়িত্ব পালন করেছি। তবে সেটি পরপর নয়। ২০১৮ সালে আমি ‘এ’ ইউনিটের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন 'এ' ইউনিটের অধীন ছিল কলা ও চারুকলা অনুষদ। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ তখন ছিল ভিন্ন। এরপর ২০২০-২১ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় আমি দায়িত্ব পেয়েছি। আর ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন পরপর দুইবার ‘সি’ ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছেন, তবে সেটি পরীক্ষার কমিটির সিদ্ধান্তে। এবার যেটি হয়েছে এতে কমিটির আপত্তি ছিল।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ইউনিটগুলোর প্রধান সমন্বয়ক নিয়োগের বিষয়টি ভর্তি পরীক্ষা ‘উপ-কমিটির (কয়েকজন ডিনদের সমন্বয়ে ছোট কমিটি) মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। সেখান থেকে তিনটি ইউনিটের জন্য তিনজনের নাম মূল কমিটিতে (সব ডিন ও চেয়ারম্যানদের সমন্বয়কে বড় কমিটি বলে) গৃহীত হয়েছে। কাজেই এটা একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়, উপ-কমিটির সিদ্ধান্ত।’

কমিটির সদস্যদের আপত্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেটি হয়েছে সেটি কমিটির মাধ্যমে হয়েছে। তারা কোনো লিখিত আপত্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানায়নি। এখনতো এসব বললে হবে না।’